অমিতাভ ভট্টাচার্য (গীতিকার, গল্প ও চিত্রনাট্য লেখক)
অনেক আগে একটা কথা শুনেছিলাম, মা কী ছিলেন, কী হইয়াছেন! আজ আমাদের বাংলায় বিনোদন জগতের দিকে তাকালে যে অবস্থায় দেখতে পাই, তাতে সত্যিই মনে হয়, মা কী ছিলেন, কী হইয়াছেন!
আমার লেখালেখির কেরিয়ার শুরু হয়েছিল একজন গীতিকার হিসাবে। ২০০৩ সালে। ঘটনাচক্রে সে সময় বেশ কয়েকটি এফএম চ্যানেলের সুবাদে বাংলা রেডিয়ো জগতে বাংলা গানের বেশ উত্তরণ হয়। আমি ব্যবসায়িক দিক থেকেই বলছি। এছাড়াও সে সময় সংগীত বাংলা, বি মিউজিক, তারা মিউজিক প্রভৃতি টিভি চ্যানেল ছিল, যারা মূলত বাংলা গান নিয়েই কাজকর্ম করত। ফলে বাংলা গানের একটা উঁচু লেভেলে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও জাগরণ ঘটে। বহু শিল্পী অনুষ্ঠানে কাজ পাচ্ছিলেন। তাঁদের গাড়ি-বাড়ি হয়। অনেক সুরকার সুনাম অর্জন করেন। সে সময় বহু বাংলা ব্যান্ড আবার নতুন করে জেগে ওঠে। চারদিকে প্রচুর জলসা হতে শুরু করে। সে সময় সিডি এসে গিয়েছে। সিডি আর অডিয়ো ক্যাসেটের বিক্রি খুব বেড়ে যায়। রিমেক থেকে বাংলা গান সরে আসে। নতুন গানের একটি চূড়ান্ত উদ্বর্তন হয় বলা যায়। ফলে আমাদের মতো নতুন যাঁরা গান লিখতে বা সুর করতে এলেন, তাঁদেরও একটা কাজের জায়গা তৈরি হল।
বাংলা গান একটি বিষয়ে অনেক আগে থেকেই সারা ভারতে এগিয়ে ছিল, সেটা হল, অন্য কোনও ভাষায় সে অর্থে আধুনিক গানের অর্থাৎ নন-ফিল্মি গানের বাজার ছিল না, যা বাংলা গানের ক্ষেত্রে ছিল। মোটামুটি পাঁচের দশক থেকেই ফিল্মের গানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলা আধুনিক গান লোকের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছিল। এখন আমি যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়েও এ এটা চলছিল। ঘটনাচক্রে সে সময় বাংলা সিনেমার গান অতটা কানে আসছিল না, কারণ সিনেমাগুলির বেশিরভাগই ছিল রিমেক আর গানেও বিশেষ নতুনত্ব মানুষের কানে আসছিল না। ফলে ২০০৩ পরবর্তী সময়ে বাংলা আধুনিক গান রাজত্ব করা শুরু করল। আমরা গান লিখে তখন গাড়ি-বাড়ি না করতে পারলেও খুব খারাপ যে রোজগার করতাম, সেটা বলা যায় না। এমনকী আমি ২০০৪ সালে গান লিখে যে টাকা পেয়েছি, সেটা সে সময় অনেক পেশাতেই পাওয়া যেত না। ফলে বোঝা যাচ্ছে যে, সুরকার, গায়ক এবং বাদ্যযন্ত্রীরা সে সময় যথেষ্ট টাকা রোজগার শুরু করেন। অডিয়ো স্টুডিওগুলিতে ভিড় বাড়ে। অনুষ্ঠান বাড়তে থাকে। বাংলা গানে একটা নতুন জোয়ার আসে।
কিন্তু সমস্যাটা শুরু হল তারপর। যে কোনও ক্ষেত্রে যখন জোয়ার আসে, তখন তার সঙ্গে কিছু বেনোজলও ঢুকে পড়ে। বাংলা গানের ক্ষেত্রেও তাই হল। কিছু ভুল মানুষ জোয়ারের জলে নিজেদের গা ভাসিয়ে দিলেন। তখনই যোগ্য-অযোগ্য পার্থক্যটা মুছে গেল এবং যেহেতু এ ফিল্ডে তখন অনেক টাকা, তাই রোজগারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমি সবটা খাব, যে টাকাটা আমি রোজগার করতে পারি, তার চেয়ে আরও বেশি রোজগার করব। অন্যদের কী হচ্ছে, কী হচ্ছে না জানার দরকার নেই। এমনটা যখন আরম্ভ হল, তখনই কিন্তু বিপদের সূচনা।
অন্য পোস্ট: নিজের মতো কাজ করতে পারলেই আমি খুশি
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মনে করুন, একজন সুরকার, যিনি মূলত সুরটাই করেন এবং তাতে অর্থ উপার্জন হয়, তিনি ভাবলেন, আমি যদি কোনও মতে সুর করার পাশাপাশি গানটাও লিখে দিতে পারি, তাহলে আমাকে গীতিকারকে টাকা দিতে হবে না। পুরোটাই আমার ঘরে চলে আসবে। যেহেতু তিনি সে অর্থে গীতিকার নন, কাজটা করার চেষ্টা করছেন, তাই তাতে গানের গুণমান নামতে শুরু করল। এবার সুরকার ভাবছেন, গায়ক তো অনেক টাকা রোজগার করে ফেলছেন, সে তুলনায় আমি কিছুই করতে পারছি না। তাই সুরকার গায়ক হওয়ার চেষ্টা শুরু করলেন। আবার সেই গুণমানের প্রশ্ন এসে গেল। বিপদ আরও বাড়ল।
আমি ২০০৭-’০৮ সালে পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখে বুঝলাম, বাংলা গানের পতন আসন্ন। আমার এক ঘনিষ্ঠ সুরকার-গায়ক বন্ধুকে সে কথা জানালাম এবং ঠিক তাই ঘটল। কারণ একদিকে মৌলিক বাংলা গানের পতন শুরু হয়, অন্যদিকে সে সময় বাংলা ছবির গানের জগতে এসে সাড়া ফেলে দেন সুরকার জিৎ গাঙ্গুলি। তিনি অত্যন্ত ভালো মানের গান তৈরি করতে লাগলেন এবং বাংলা চলচ্চিত্র জগতে নতুন জোয়ার এল। তখনও রিমেক ফিল্ম তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু গানগুলি ছিল নিতান্তই মৌলিক আর ভালো। সে গান হিট হওয়া শুরু করল এবং বিভিন্ন এফএম, টিভি চ্যানেলে আধুনিক বাংলা গানের জায়গা দখল করে নিল ফিল্মের গান। কিন্তু তারপর শুরু হল খেয়োখেয়ি।